জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
মানব শরীরে কাজ করছে না অ্যান্টি-বায়োটিক। আইসিইউতে বেশির ভাগ রোগীর মৃত্যুর কারণ অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে কাজ না করা। শুধু আইসিইউ, সিসিইউর রোগীরাই নয়, শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সি মানুষের শরীরেই এখন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে জীবাণু। স্বাস্থ্য ঝুঁকির এই বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। অনেকটা অশনি সংকেত।
সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ বারবার ঘোষণা দিচ্ছেন রেজিস্টার্ড ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন ও বিক্রি বন্ধ করা। এরপরেও অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ঠেকানো যাবে না বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে স্বাস্থ্য প্রশাসন এ রকমও অভিযোগ কম নয়।
সম্প্রতি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) ল্যাবে নমুনা পরীক্ষায় ৩৩ শতাংশ রোগীর এন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স (অকার্যকর) পাওয়া গেছে। গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত চমেকের মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবে রোগীদের রক্ত, পুঁজ, কফসহ বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষায় এ তথ্য উঠে আসে। যেখানে হাসপাতালে ভর্তি এবং বহির্বিভাগের রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স হওয়া ৩৩ ভাগের মধ্যে ৭৫ ভাগই ছিল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী। এসব রোগীর সবচেয়ে বেশি জীবাণুরোধী প্রতিরোধ পাওয়া গেছে ক্লেবসেইলা এবং এসিন্যাটোব্যাকটার নামক দুটি ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যে। এদের মধ্যে সাধারণত বাজারে ব্যবহৃত হয় এমন বিভিন্ন এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া ছিল অনেক বেশি।
চিকিৎসকরা বলছেন, এন্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতারোধে শুধুমাত্র মানুষের সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, এজন্য চিকিৎসকদের পাশাপাশি ফার্মাসিউটিকেল সেক্টর, গবাদি পশু প্রতিপালনকারী, মৎসখামারী, কৃষকসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে।
অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স কী?
যদি কারও শরীরে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণজনিত রোগ হয় এবং সেই রোগ নিরাময়ে কেউ যদি চিকিৎসকের পরামর্শমত সঠিক পরিমাণে এবং পর্যাপ্ত সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ না করেন তাহলে ব্যাকটেরিয়াগুলো পুরোপুরি ধ্বংস না হয়ে উল্টো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। তখন এই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ওই অ্যান্টিবায়োটিক পরে আর কাজ করে না। অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের পরেও ব্যাকটেরিয়ার এই টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জনকে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বলা হয়।
দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে সাধারণ রোগ নিয়ে চিকিৎসা নেয়া অনেক মানুষের মধ্যে এই অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স দেখা দিয়েছে। এর ফলে রোগীর আগে যে অ্যান্টিবায়োটিকে রোগ সারতো, এখন আর সেটি কাজ করছে না। না হলে অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হচ্ছে।
এভাবে মানুষের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে বলে চিকিৎসকরা জানান।
অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্সের কারণ কী?
বিশ্বে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হতে যে সময় লাগে ওই সময়ের মধ্যেই কয়েকগুণ বেশি হারে বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স। যার ফলে অদূর ভবিষ্যতে সামান্য হাঁচি-কাশি-জ্বরেও মানুষের মৃত্যু-ঝুঁকি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অনেকেই জ্বর, মাথাব্যথা হলেই চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেন। আবার অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক নিলেও সেটার পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন করেন না। কয়েকটি খাবার পর ভালো বোধ করলেই ছেড়ে দেন। ফলে ওই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিকের আর কোন প্রভাব থাকে না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
প্রকৃতি পরিবেশ থেকে হতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স:
আবার অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ম করে খাওয়া সত্ত্বেও শিশুরাও অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্সের শিকার হতে পারেন। এর কারণ প্রকৃতি-পরিবেশে অ্যান্টিবায়োটিকের বিস্তার। ইদানীং মাছ, হাঁস, মুরগি বা গরুকে অ্যান্টিবায়োটিক-যুক্ত খাবার দেয়া হয়। আবার শাকসবজির উৎপাদনেও ব্যবহার হয় অ্যান্টিবায়োটিক। ফলে এসব প্রাণীর কাঁচা মাংসের সংস্পর্শে এলে, আধা-সেদ্ধ অবস্থায় খেলে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
চমেক মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সাবরিনা শারমীন বলেন, প্রতি তিনমাসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া রোগীদের নমুনা পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত রোগীদের নমুনা কালচার পরীক্ষা করে ৩৩% রোগীর জীবাণুর মধ্যে রেজিস্টেন্স পাওয়া গেছে।
ডা. সাবরিনা শারমীন আরও বলেন, শরীরকে জীবাণুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে শরীরে জীবাণুর আক্রমণকে প্রতিহত করা হয়। সাধারণত ব্যাক্টেরিয়া ও ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে এন্টিবায়োটিক ওষুধ খাবার জন্য চিকিৎসক প্রেসক্রিপশন দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন ছাড়াও এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে রোগ-জীবাণু এন্টিবায়োটিকে আর ধ্বংস হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, এছাড়াও উচ্চফলনের লক্ষ্যে গবাদি পশু, মাছ চাষে কিংবা কৃষিকাজে গত শতাব্দী থেকে বিশ্বজুড়ে এ জীবাণুরোধী ওষুধের ব্যবহার বেড়েছে। যার ফলে সুস্থ মানবদেহে এসব জীবাণুরোধী ওষুধ খাবারের মাধ্যমে ঢুকে যায়। এতে জীবাণু প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি ও ডোজ থাকে না।
চমেক মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রিপন বড়ুয়া বলেন, এসব এন্টিবায়োটিক ও জীবাণুরোধী ওষুধ যেসব জীবাণুকে মারতে পারে, সেসব জীবাণু শরীরে কিংবা পরিবেশে আগে থেকেই জীবাণুরোধী ওষুধ সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়ে যায়। এর ফলশ্রুতিতে জীবাণুর শরীরে মিউটেশনের মাধ্যমে জীবাণুরোধী ওষুধের বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধ ব্যবস্থা জন্ম নেয়। এভাবে বাংলাদেশে অনেক ওষুধ কার্যকারিতা হারিয়েছে। এই অবস্থার সবচেয়ে খারাপ দিক হলো দেশে অনেক রোগীরই এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স বা জীবাণুরোধী ওষুধের কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।